বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । তিনি যেমন অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছেন তেমনিভাবে লিখেছেন গান । সে সব গানে নিজে সুর দিতেন এবং গাইতেন নিজেই । কাজী নজরুল ইসলাম সারা জীবন মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন । আজ আমারা সংক্ষিপ্ত ভাবে তার জীবনী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো ।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী
একনজরে
নাম | কাজী নজরুল ইসলাম ( Kazi Nazrul Islam ) |
জন্ম | ১৮৯৯ সালে ২৪শে মে |
ছদ্দনাম | দুখুমিয়া |
পেশা | গীতিকার, সুরকার, কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং সম্পাদক |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | নজরূলগীতি, অগ্নিবীনা, বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা, বিষের বাঁশি প্রভৃতি |
স্ত্রী | নার্গিস আরা খানম, প্রমিলা দেবী |
মৃত্যু | ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (৭৭ বছর ) |
মৃত্যস্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ |
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও বাল্য জীবন
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন । তার বাবা ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানিয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম । কাজী নজরুল ইসলামের বয়স যখন মাত্র ৯ বছর তখন তার পিতা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় । এসময় কাজী নজরুল ইসলাম মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাত্র দশ বছর বয়সে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হন । এই সময় তিনি ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তিকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুল প্রভাব ফেলে । বাল্য বয়সেই নজরুল লেটো দলে যোগ দেন । তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের উস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার যথেষ্ট দখল ছিল । চাচা বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দেন । এই লেটো দলেই কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য চর্চা শুরু হয় । তিনি লেটো দলের জন্য কবিতা ও গান লিখতে শুরু করেন এবং বেশ কিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন । এই সময় তিনি অভিনয়ও আয়ত্ব করেন ।
কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষা জীবন
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন । এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রাণীগঞ্জের “সিয়ারসোল রাজ স্কুল” এরপর ভর্তি হন ”মাথরুন উচ্চ ইংরেজী স্কুলে” । কিন্তু, আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি এখানে বেশী দিন পড়াশোনা করতে পারেননি । ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয় । এ সময় তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন । এরপর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা নিযুক্ত হন এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন । এসময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ নজরুলের কবি প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন । ১৯১৫ সালে তিনি আবার রাণীগঞ্জের “সিয়ারসোল রাজ স্কুলে” ফিরে যান এবং সেখানে ৮ম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন । কিন্তু, মাধ্যমিকের গন্ডি শেষ না করেই তিনি ১৯১৭ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন ।
সৈনিক জীবন
১৯১৭ সাল । তখন প্রথম বিশ্ব চলছে । কবি নজরুলের ইচ্ছে হলো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার । আর তাই ১৯১৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন । প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সিমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান । প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন শুরু করেন । এই সময় তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যন্ত উন্নীত হন । সেনাবাহিনীতে তার সহকর্মী ছিলেন পাঞ্জাবী এক মৌলভি । নজরুল এই সহকর্মীর কাছ থেকে তিনি ফার্সি ভাষা আয়ত্ব করেন । সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম তার সাহিত্য কর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন । ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি সৈনিক জীবন শেষ করে কলকাতায় ফিরে আসেন ।
আরো পড়ুন মুনীর চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সাহিত্য জগতে কবি নজরুলের অবদান
সাহিত্যের প্রত্যেকটি অঙ্গনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল সরব উপস্থিতি । এখানে আমরা সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ।
কাব্য গ্রন্থ
কবি নজরুলের মোট ৭টি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।
১ । অগ্নিবীণা ( ১৯২২ সালের ২৫ অক্টোবর )
২ । সাম্যবাদী ( ১৯২৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর)
৩ । ঝিঙে ফুল ( ১৯২৬ সালের ১৪ই এপ্রিল )
৪ । সিন্দু হিন্দোল ( ১৯২৮ সাল )
৫ । চক্রবাক ( ১৯২৯ সালের ১২ই আগস্ট )
৬ । নতুন চাঁদ (১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে )
৭ । মরুভাস্কর ( ১৯৫১ সাল )
বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতাটি অগ্নিবীণার অন্তর্ভুক্ত
কবিতা ও গান
১ । দোলন-চাঁপা (১৯২৩ সাল) ২ । বিষের বাঁশি (১৯২৪ সাল) ৩ । ভাঙ্গার গান (১৯২৪ সাল) ৪ । চিত্তনামা (১৯২৫ সাল) ৫ । ছায়ানট (১৯২৫ সাল) ৬ । পুবের হাওয়া (১৯২৬ সাল) ৭ । সর্বহারা (১৯২৬ সাল) ৮ । ফণী-মনসা (১৯২৭ সাল) ৯ । সঞ্চিতা (১৯২৮ সাল) ১০ । জিঞ্জীর (১৯২৮ সাল) ১১ । সন্ধা (১৯২৯ সাল) ১২ । প্রলয় শিখা ( ১৯৩০ সাল ) ১৩ । নির্ঝর (১৯৩৯ সাল) ১৪ । সঞ্চয়ন ( ১৯৫৫ সাল) ১৫ । শেষ সওগাত (১৯৫৯ সাল) ১৬ । ঝড় ( ১৯৬১ সাল )
সংগীত
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কর্ম জীবনে ৫৬০০ এর বেশী গান রচনা করেছেন । পৃথীবির ইতিহাসে একক হাতে এক ভাষায় এত গান রচনার নজির আর নেই । নিচে তার সম্পাদিত সংগীত গ্রন্থগুলোর নাম দেওয়া হলো
১ । বুলবুল (১৯২৮ সাল) ২ । সন্ধা (১৯২৯) ৩ ।চোখের চাতক (১৯২৯) ৪ । নজরুল গীতিকা (১৯৩০ ) ৫ । নজরুল স্বরলিপি (১৯৩১) ৬ । চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১) ৭ । সুরসাকী (১৯৩২) ৮ । বনগীতি (১৯৩১) ৯ । জুলফিকার (১৯৩১) ১০ । গুল বাগিচা (১৯৩৩) ১১ । গীতি শতদল (১৯৩৪) ১২ । সুর মুকুল (১৯৩৪) ১৩ । গানের মালা (১৯৩৪ ) ১৪ । স্বরলিপি (১৯৩৯) ১৫ । বুলবুল দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫২) ১৬ । রাঙ্গা জবা (শ্যামা সংগীত)১৯৬৬
গল্প গ্রন্থ
১ । ব্যথার দান (১৯২২) ২ । রিক্তের বেদন (১৯২৫ ) ৩ । শিউলি মালা (১৯৩১) ৪ । হক সাহেবের হাসির গল্প ৫ । সাপড়ে (আখ্যান )
ব্যাথার দান নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ
উপন্যাস
১ । বাঁধন হারা (১৯২৭)
২ । মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০)
৩ । কুহেলিকা (১৯৩১)
নাটক
১ । ঝিলিমিলি (১৯৩০) ২ । আলেয়া (১৯৩১) ৩ । পুতুলের বিয়ে ১৯৩৩) ৪ । মধুমালা (১৯৬০) ৫ । ঝড় (১৯৬০) ৬ । পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (১৯৬৪)
প্রবন্ধ ও নিবন্ধ
১ । যুগবানী (১৯২২) ২ । ঝিঙ্গে ফুল (১৯২৬) ৩ । দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬) ৪ । রুদ্র মঙ্গল (১৯২৭) ৫ । ধুমকেতু (১৯৬১) ৬ । রাজবন্দির জবানবন্দি
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলাদেশে
- ১৯৭৬ সালের জানুয়রি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবি কাজী নজরুর ইসলামকে নাগরিকত্ব প্রদান করে ।
- একই বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
- ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অব লেটার্স (ডি. লিট) উপাধিতে ভূষিত করে ।
- ময়মনসিংহ জেলায় ২০০৫ সালে “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় “ নামে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
- কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় ।
- তার রচিত “ চল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গ্রহন করা হয় ।
ভারতে
- ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার “ জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” প্রদান করে ।
- ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা “পদ্মভূষণ” এ ভূষিত করে ।
- আসানসোলের কাছে দুর্গাপর মহানগরের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম রাখা হয়েছে “কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর” ।
- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কলকাতার যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়কটির নাম রাখা হয়েছে ”কাজী নজরুল ইসলাম স্বরণি” ।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলাম পরলোক গমন করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় জামে মসজিদের পাশে তাকে জাতীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় ।
আরো পড়ুন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী