ঋতু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শীতের আগমন ঘটেছে । শীত মৌসুমে বাজারে হরেক রকমের শাক-সবজির সমাগম ঘটে । এসব বৈচিত্র্যময় শাকসবজি একেকটা একেক রকমের গুণাগুণে ভরপুর । এজন্য পুষ্টিগুণে শীতের শাক-সবজির জুড়ি নেই । শীতের শাক-সবজির মধ্যে রয়েছে ফুলকপি , বাঁধাকপি , শালগম , টমেটো , মুলা , শিম , মটরশুঁটি , লালশাক , পালংশাক , ব্রোকলি , গাজর , লাউ , ধনিয়াপাতা , পেঁয়াজপাতা ইত্যাদি । শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে এসব সতেজ শাক-সবজিতে । আর প্রায় সকল শাক-সবজিতেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট , যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে । আজকের লেখাতে আমরা শীতের শাক-সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করবো ।
শীতকালীন শাক-সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা :
১ । পালং শাক :
শীতের শাকগুলোর মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই পছন্দের একটি শাক হলো পালংশাক । পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট , ভিটামিন সি , ভিটামিন বি , ভিটামিন এ , ম্যাগনেশিয়াম ও রয়েছে উচ্চমাত্রায় বিটা-ক্যারোটিন । এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও ত্বকের ব্যার্ধক্য ছাপ দূর করে । পালংশাকে থাকা উচ্চ মাত্রার ম্যাগনেশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে । এতে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম , আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড । যা আমাদের হাড় কে মজবুত করে তোলে ও মানসিক স্বাস্থ ভালো রাখে । পালংশাকে থাকা ক্যারোটিনয়েডস প্রটেস্ট ক্যান্সার ও ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধ করে । ভিটামিন ডি ছাড়া সকল ভিটামিনই বিদ্যামান রয়েছে এটিতে । তাই পুষ্টিগুণ ও উপকারিতার দিক থেকে পালংশাক এককথায় অসাধারন ।
২ । টমেটো :
টমেটো শীতকালীন সবজি হলেও এটি এখন সারা বছরই পাওয়া যায় । অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সবজি টি পুষ্টিগুণ ও ক্যালোরিতে ভরপুর । টমেটোতে রয়েছে ভিটামিন এ , বি ,সি , কে , ম্যাগনেশিয়াম এবং ফসফরাস । এর ভিটামিন সি ঠান্ডা-জ্বর প্রতিরোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । টমেটোতে থাকা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন কে হাড় মজবুত ও সুস্থ রাখে । টমেটোর ভিটামিন এ , বি ও পটাশিয়াম কোলেস্ট্রোলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে । টমেটোতে রয়েছে লাইকোপিন যা ত্বক সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখে । এটি চুল ভালো রাখতেও কার্যকরী । টমেটো আপনি কাঁচা অথবা পাঁকা যেকোন অবস্থাতেই খেতে পারেন । তবে বেশি তাপে এর পুষ্টিগুণ অনেকটাই নষ্ট হয় ।
৩ । শিম :
শীতকালীন সবজি শিম সকলেই কম বেশি পছন্দ করে থাকেন । অত্যন্ত পুষ্টিকর এ সবজিটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন সি, জিংক আর মিনারেল । শিমে ক্যলোরির পরিমান কম থাকাতে এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে । এতে রয়েছে ডায়েটারি ফাইবার যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে । শিমের বিচি প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। যাঁরা মাছ-মাংস কম খান , তাঁরা শিমের বিচির মাধ্যমে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে পারেন । শিমে থাকা খনিজ চুল পড়া প্রতিরোধ করে ও চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করে । শীতে ত্বকের শুষ্কতা ও প্রাণহীন ভাব দূর করতে নিয়মিত শিম খেতে পারেন , এটি ত্বক সুস্থ রাখে । এছাড়া এটি কোলন ক্যান্সার রোধ করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ।
৪ । ফুলকপি :
শীতের অন্যতম সবজি ফুলকপিতে রয়েছে ভিটামিন বি, সি, কে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংক । এটি খুবই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি সবজি । গবেষণায় জানা গেছে ফুলকপির উপরিভাগের কচিপাতায় ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান রয়েছে । এবং অন্য সকল শাক-সবজির চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে এর কচি পাতায় । প্রতি ১০০ গ্রাম ফুলকপির কচি পাতায় ৬২৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ৪০ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে । ফুলকপির আয়রনের পরিমাণ আলু, মুলা, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, টমেটো, চিচিঙ্গা ও ঝিঙ্গার চেয়ে বেশি ।
আরো পড়ুন শীতে ত্বকের বাড়তি যত্ন
৫ । বাঁধাকপি :
শীতের আরেক আকর্ষণীয় ও পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজি বাঁধাকপি । এতে রয়েছে ভিটামিন সি ও ভিটামিন কে । বাঁধাকপির ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও বিভিন্ন সংক্রমন থেকে রক্ষা করে । এটি ত্বক এবং চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে । ভিটামিন কে হাড় সুস্থ রাখে এবং শরীরের প্রতিটি অংশে রক্ত প্রবাহ ঠিক রাখতে সহায়তা করে । এতে রয়েছে প্রচুর ফাইবার এবং কম মাত্রায় ক্যালোরি যা ওজন কমাতে সাহায্য করে । বাঁধাকপি রক্তে চর্বি ও শর্করার মাত্রা কমায় ফলে এটি ডায়াবেটিস রোগির জন্য খুবই উপকারি ।
৬ । শালগম :
শালগম অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি শীতকালীন সবজি । এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন এ , সি , কে , ক্যালসিয়াম , পটাশিয়াম এবং প্রচুর পরিমাণে আঁশ । এর পাতা শাক হিসেবে খাওয়া যায় যা অত্যন্ত পুষ্টিকর । শালগম অনেক এলাকাতে ওলকপি নামেও পরিচিত । শালগম দেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে । ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ঘন ঘন ঠান্ডা-জ্বর হওয়া রোধ করে । এটি ডায়াবেটিস রোগিদের জন্য বিশেষ উপকারি । ভিটামিন এ ইমিউন সিস্টেম ঠিক রাখে ও ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করে । শালগম ভিটামিন এ তে ভরপুর ফলে এটি দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে ।
৭ । মুলা :
শীত মৌসুমের প্রধানতম একটি সবজি হলো মুলা । মুলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমান ভিটামিন সি । এটি আপনি কাঁচা সালাদ বা রান্না উভয় ভাবেই খেতে পারেন । মুলার রয়েছে প্রচুর ঔষধী গুণ । মুলায় রয়েছে ক্যারোটিনয়েডস যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং ওরাল , পাকস্থলী , বৃহদন্ত , কিডনী এবং কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে । শ্বেত রোগের চিকিৎসায় মূলা খুবই কার্যকর । এটি রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে । এবং লিভার ও পাকস্থলীর সমস্ত দুষন এবং বর্জ্য পরিষ্কার করে । মুলা অর্শ রোগ প্রতিরোধ করে এবং কিডনি রোগসহ মূত্রনালির অন্যান্য রোগের জন্য উপকারী ভুমিকা পালন করে ।
৮ । গাজর :
শীতকালীন গাজরকে বলা হয় সুপারফুড । এটি দেখতে যেমন চোখ জুড়ানো তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর । গাজরে রয়েছে ভিটামিন সি , কে , বি , ফাইবার , পটাশিয়াম , ক্যালসিয়াম , ফসফরাস , ম্যাগনেসিয়াম এবং লৌহ । গাজর বিটাক্যারোটিনের অন্যতম উৎস যা লিভারে গিয়ে ভিটামিন এ তে রুপান্ত্রিত হয় । যা আমাদের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে ও রাতকানা রোগ থেকে বাঁচায় । গাজরের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফুসফুস , ব্রেস্ট ও কোলন ক্যান্সারের ঝুকি কমায় । এর খনিজ উপাদান ত্বক সুস্থ রাখে ও ত্বকে বয়সের ছাপ রোধ করে । গাজর লিভারের প্রদাহ , ফোলা ভাব ও সংক্রমন রোধ করে । এবং এটি ভালো অ্যান্টিসেপটিক হিসেবেও কাজ করে ।
৯ । ব্রোকলি :
শীতকালীন সবজি ব্রোকলি বর্তমানে দেশের প্রায় সব স্থানেই পাওয়া যায় । এতে রয়েছে প্রচুর পরিমান ভিটামিন সি । দিনে অল্প পরিমান ব্রোকলি খেলেই সারাদিনের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরন হয়ে যায় । ব্রোকলিতে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন ও সেলিনিয়াম যৌথ ও ভিটামিন সি যা প্রোস্টেট, কোলন, ফুসফুস, যকৃত, ব্রেস্ট ও প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে । এর ভিটামিন সি ত্বক সুন্দর রাখে ও দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে । ব্রোকলিতে চর্বি ও ক্যালরি কম থাকে এবং আঁশ বেশি থাকে । ফলে এটি ওজন কমায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে ।
১০ । ধনিয়াপাতা :
শীতকালের একটি অন্যতম আকর্ষণ হলো পুষ্টিগুণে ভরপুর ধনিয়াপাতা । প্রায় মানুষই এর উপকারিতা না জেনেই এটি পছন্দ করেন । সবজি রান্না , ভর্তা কিংবা সালাদ যাই হোক ধনিয়াপাতার জুড়ি মেলা ভার । এতে রয়েছে ভিটামিন এ ,সি, কে , আয়রন , ম্যাগনেসিয়াম , ক্যালসিয়াম , ফসফরাস , জিংক ইত্যাদি । ধনিয়াপাতা শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমায় ভাল কোলেস্টরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে । কারন এতে কোলেস্টেরল এর মাত্রা শূন্য । এর ভিটামিন এ চোখের জন্য উপকারি । ধনিয়াপাতার ভিটামিন কে মস্তিষ্কের রোগ অ্যালঝেইমার চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী । তবে এটি রান্নার থেকে কাঁচা খাওয়ায় ভালো ।
আরো পড়ুন করলার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
শরীরের জন্য দরকারি ভিটামিন ও মিনারেলসের অন্যতম উৎস হল শাক-সবজি । ভিটামিন ও মিনারেলস আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরকে খাদ্যের শর্করা , আমিষ ও চর্বির ব্যবহারে সহায়তা করে । অর্থাৎ আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শাক-সবজির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে । শীত মৌসুমে শাক-সবজিতে ভরপুর থাকে আমাদের বাজার গুলো । তাই এই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা উচিত নয় ।