ম্যালেরিয়া একটি প্রাচীনতম এবং জটিল রোগের নাম । বিশ্বে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয় । মশাবাহিত এই রোগটির আক্রমণ ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত । আজ আমরা ম্যালেরিয়া কেন হয়, ম্যালেরিয়ার লক্ষণ এবং এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করবো ।
ম্যালেরিয়া কেন হয়
ম্যালেরিয়া অ্যানোফেলিস নামক মশার কামড়ে হয় । এবং শুধুমাত্র ম্যালেরিয়ার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার কামড়ে এই রোগ হয় । এ পর্যন্ত ষাটের অধিক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করা হয়েছে । এর মধ্যে শুধুমাত্র ৪টি প্রজাতি মানুষের ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী । প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি এবং ওভাল-এর যেকোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হতে পারে । সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় ।
ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ
১. নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ । জ্বর সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে । নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে । যেমন- একদিন পর পর জ্বর আসা এবং তা তিন চার ঘণ্টা দীর্ঘ হওয়া এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায় । জ্বর ছেড়ে গেলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে । এ ছাড়াও মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব হতে পারে , গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা সেই সাথে মাথাব্যথা থাকতে পারে ।
২. অনিদ্রা , জ্বরের পাশাপাশি ঘুম কমে যেতে পারে ।
৩. কাবারে অরুচি । খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া বা ক্ষুধামন্দা হওয়া ।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিবমি ভাব অথবা বমি হওয়া । হজম শক্তি কমে যাওয়া ।
৫. শরীর ঘামা, খিঁচুনিহওয়া , অতিরিক্ত পিপাসা লাগা, ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা ।
৬. মাংসপেশি, তলপেটে ব্যথা অনুভব করা ।
৭. প্লীহা ও যকৃত বড় হয়ে যাওয়া সেই সাথে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় ।
৮. ম্যালেরিয়া রোগের সবচেয়ে জটিলতম ধরন হলো ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’। সাধারণ ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি এই ম্যালেরিয়ায় বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন রক্তশূন্যতা, কিডনি বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট হওয়া, জন্ডিস, খিঁচুনি, রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় । জরুরি চিকিৎসা না পেলে এসব রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, এমন কি কোন কোন সময় রুগির মৃত্যুও হতে পারে।
ম্যালেরিয়ার রোগ নির্ণয়
যদি রোগির সাথে ম্যালেরিয়ার লক্ষণগুলো মিলে যায়, আর প্রথমবার পরীক্ষায় যদি ম্যালেরিয়ার কিছু না পাওয়া যায়, তবে পর পর তিন দিন পরীক্ষাটি করা উচিত । যদি পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়, তাহলে দেরি না করে বা উদ্বিগ্ন না হয়ে দ্রুত বিষেশজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত ।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে করণীয়
যদিও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি । তবে ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য । মশাবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হলে সচেতনতা অবলম্বন করা দরকার । মশার কামড় থেকে দূরে থাকাই এ রোগ প্রতিরোধের একম্ত্র উপায় । ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য কিছু করণীয় রয়েছে । যেমন- দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানানো । মশার কয়েল ব্যবহার করা । দরজা-জানালায় মশক নিরোধক জাল দিয়ে দেওয়া । শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা । ঘরের আশপাশে কোথাও যেন পানি জমে মশা বংশবিস্তার না করতে পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা । স্থির জলাধার বা জলাবদ্ধ এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার করা । জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পাড়ে বেশি । এসব স্থানে মশা নিধন করা ওষধ, কীটনাশক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দেওয়া ।
ম্যালেরিয়া রোগটি কেন মারাত্মক ?
মশার দ্বারা সংক্রমিত ম্যালেরিয়া রোগটি কেন, কিভাবে প্রাণঘাতী রোগ হয়ে উঠলো, এ বিষয়ের অজানা তথ্য উঠে এসেছে রোগটির ওপর গবেষকদের জেনেটিক গবেষণায় । ক্যামব্রিজের ওয়েলকাম স্যাংগার ইন্সটিটিউটের গবেষকদের নেতৃত্বে এক গবেষণায় জানা যায়, এ পরজীবীটির বংশতালিকা অনুযায়ী ৭ ধরনের ম্যালেরিয়ার বিষয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে ।
সেখানে তারা দেখতে পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে এই জীবাণুটি রূপান্তরিত হয়ে রোগের নতুন একটি “শাখায়” রূপান্তরিত হয় । যা মানব জাতির জন্য মারাত্মক সংক্রমণের কারণ । নেচার মাইক্রোবায়োলজি নামের একটি জার্নালে এই গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ।
এই রূপান্তরে তখন এমন একটি জিনগত পরিবর্তন ঘটে যার কারণে ম্যালেরিয়ার জীবাণু মানব শরীরের লোহিত কণিকায় আক্রমণ করতে পারে ।
এই গবেষকদের একজন ডক্টর ম্যাট বেরিম্যান বলেন, “আমাদের গবেষণায় প্রতিটি পদক্ষেপের ফলাফল একত্রিত করে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ম্যালেরিয়ার সেসব জীবাণু শুধু মানব শরীরে প্রবেশই করছে তা নয়, সেখানে থেকে যাচ্ছে এবং মশার মাধ্যমে পরিবাহিত হচ্ছে ।”
ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী যে ভয়াবহ পরজীবী বা প্যারাসাইট বিশ্বজুড়ে এই জটিল স্বাস্থ্য সংকটের জন্য দায়ী, সেটি হল ‘প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’।
স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে মানুষের দেহে এটি ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে ।
ম্যালেরিয়া চিকিৎসা
চিকিৎসায় ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণ ভাল হয় । তাই জ্বর হলে বা শরীরে ম্যালেরিয়ার কোন লক্ষণ দেখা দিলে, দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান । ডাক্তার আপনার জ্বরের কারণ সনাক্ত করে চিকিৎসা দিবেন । ম্যালেরিয়া যদি হয়ে থাকে, তবে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা, রোগির বয়স ও অন্যান্ন দিক খেয়াল করে ডাক্তারই দিবেন । তাই এ ক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিত ।