পৃথিবীতে যতজন সেরা জ্ঞানী ব্যক্তি গত হয়েছেন, তাদের একজন হলেন ইবনে সিনা । তার পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা । তার নাম শোনেনি এমন কাউকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না । তিনি ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক । ইবনে সিনা সর্ববিদ্যায় পারদর্শী একজন ব্যক্তি ছিলেন । জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তিনি অবদান রাখেন নি । মধ্যযুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে ইবনে সিনার অবদান সবচেয়ে বেশি । আজকে আমরা, অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ইবনে সিনার জীবনী আলোচনা করবো ।
ইবনে সিনার জন্ম
ইবনে সিনা ৯৮০ সালে উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে ইবনে সিনার জন্ম, যা বর্তমানে উজবেকিস্তানে অবস্থিত । তার পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা । ইবনে সিনার পিতার নাম ছিল আবদুল্লাহ এবং মায়ের নাম ছিল সিতারা বিবি । ইবনে সিনার পিতা আবদুল্লাহ বুখারার সামানীয় সম্রাটের অধীনে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন ।
আরো পড়ুন কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী
ইবনে সিনার শিক্ষাজীবন
প্রথম বয়স থেকেই ইবনে সিনা ছিলেন তুখোড় মেধাবী । মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ কোরআনের হাফেজ হন । এছাড়া তিনি সূক্ষ্ণ ও জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন । ইবনে সিনার পিতা তাকে পড়ানোর জন্য তিন জন গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেন । তাদের মধ্যে ইসমাইল সূফী নামে একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি তাকে শিক্ষা দেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র আর তাফসীর বিষয়ে । মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিতশাস্ত্র । বিখ্যাত দার্শনিক আল না তেলি তাকে শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জাওয়াহির, মানতিক প্রভৃতি ।
দার্শনিক ইবনে সিনা
ইবনে সিনার আরেকজন শিক্ষক ছিলেন আল নাতেলী । ইবনে সিনা তার কাছে ফিকহ, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষা নেন । ইবনে সিনার প্রতিভা ও জানার আগ্রহের কাছে আল নাতেলীর মত জ্ঞানী ব্যক্তিও হার মানেন । তাই আল নাতেলী ইবনে সিনাকে নিজে স্বাধীন মত গবেষণা করার জন্য উপদেশ দেন । তাই ইবনে সিনা নিজে নিজেই জ্ঞান সাধনা মধ্যে মনোনিবেশ করেন । এই পর্যায়ে তিনি ইউক্লিড ও টলেমির মত বিজ্ঞানীর লেখাও পড়ে ফেলেন । তিনি একই সাথে এরিস্টটলের দর্শন শাস্ত্রও সম্পূর্ণ ধাতস্থ করে ফেলেন । কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে কিংবা জটিল কোনো বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতে থাকতেন, যতক্ষণ না সমস্যার সমাধান পেতেন ।
আরো পড়ুন পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের সংক্ষিপ্ত জীবনী
ডাক্তার ইবনে সিনা
মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে ডাক্তার হওয়ার জন্য পড়ালেখা শুরু করেন ইবনে সিনা । এবং ১৮ বছর বয়সেই তিনি পুরোদমে ডাক্তার হয়ে যান । এই অল্প বয়ষেই তার খ্যাতি দুর-দুরান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইবনে সিনা বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন ।
লেখক হিসাবে ইবনে সিনা
জীবনে অনেক দেশ ভ্রমণ করেন ইবনে সিনা । সেই সাথে অর্জন করেন প্রচুর অভিজ্ঞতা । তিনি এই সমস্ত বিষয়ে প্রায় শতাধিক বই রচনা করেন । ২১ বছর বয়সে ইবনে সিনা আল মুজমেয়া নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন । এই বিশ্বকোষের মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি তিনি লিপিবদ্ধ করেন । ইবনে সিনার আরেকটি বিখ্যাত রচনা হলো কিতাব আল-শিফা, যা একটি দার্শনিক গ্রন্থ । এটি ২০ খন্ডে বিভক্ত। ইবনে সিনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল কিতাব আল ইশারাত । তাছাড়া তার লেখা আরযুযা ফিত-তিব, লিসানুল আরব, আলমজনু, আল মুবাদাঊন মায়াদা, মা দুনিয়াত(খনিজ পদার্থসমূহ), Treaties of Minerals উল্লেখযোগ্য ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা
চিকিৎসা বিষয়ে ইবনে সিনার অমর গ্রন্থ আল কানুন ফিত-তিব । আল কানুন গ্রন্থটি ৫ খন্ডে বিভক্ত । এই গ্রন্থটি ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠানসমূহে পড়ানো হত । এখন পর্যন্ত ইউনানী চিকিৎসায় এই বইয়ের অবদান অপরিসীম। ইবনে সিনা হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা । তিনিই মানুষের চোখের সঠিক এনাটমির বর্ণনা দেন । মেনিনজাইটিস রোগ ও তিনিই প্রথম সনাক্ত করেন ।
আরো পড়ুন ফররুখ আহমদের সংক্ষিপ্ত জীবনী
ব্যক্তি হিসেবে ইবনে সিনা
ইবনে সিনা স্বাধীনচেতা এবং আত্মমর্যাদা সচেতন ব্যক্তি ছিলেন । জীবনের নানা উত্থান পতনের মধ্যেও তিনি কখনো জ্ঞানচর্চা করা ছেড়ে দেন নি । তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু এবং ধীসম্পন্ন একজন মহান ব্যক্তি । জ্ঞান চর্চাই ছিল তার জীবনের মূখ্য কাজ ।
ইবনে সিনার মৃত্যু
একটি যুদ্ধ শিবিরে অবস্থান কালে ইবনে সিনা তলপেটের ব্যাথায় কাবু হয়ে পড়েন । এই রোগেই এই মহান সাধক ১০৩৭ সালে, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ।