টমাস আলভা এডিসন, যিনি ১০ হাজার বার চেষ্টার পর বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করতে সক্ষম হন । তার মত সমৃদ্ধ জীবন খুব কম মানুষেরই আছে । তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল মানুষ । আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতি, সাউন্ড রেকর্ডিং, ভিডিওগ্রাফি সহ মোট ১০৯৩টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে তাঁর নামে । একজন বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক হওয়ার পাশাপাশি টমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা । আধুনিক কালের ইলন মাস্ক বা স্টিভ জবস এর মত জিনিয়াসরা তাঁকে একবাক্যে গুরু মানেন । ইলন মাস্ক বেশ কয়েকবার বলেছেন যে তাঁর প্রধান অনুপ্রেরণা হলেন টমাস আলভা এডিসন । টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরেই বর্তমান যুগের প্রযুক্তির শুরু । আজ আমরা টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো ।
টমাস আলভা এডিসন কে ছিলেন ?
টমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন মার্কিন বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক এবং ব্যবসায়ী । তিনি গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা এবং বৈদ্যুতিক বাতি সহ বহু যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যা বিংশ শতাব্দীর জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
একনজরে টমাস আলভা এডিসন
নাম | টমাস আলভা এডিসন |
জন্ম | ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭ |
জন্মস্থান | মিলান, ওহাইয়ো |
পিতামাতা | স্যামুয়েল ওগডেন এডিসন জুনিয়র ন্যান্সি মেথিউস এলিয়ট
|
স্ত্রী | মেরি স্টিলওয়েল মিনা এডিসন |
পেশা | বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী
|
মৃত্যু | ১৮ অক্টোবর ১৯৩১, ওয়েস্ট অরেঞ্জ, নিউ জার্সি । |
টমাস আলভা এডিসন এর জন্ম
টমাস আলভা এডিসন ১৮৪৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী আমেরিকার ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের মিলান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন । তবে টমাস আলভা এডিসন পোর্ট হুরন, মিশিগানে বেড়ে উঠেন । কারণ তার পরিবার ১৮৫৪ সালে এই স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন । তিনি ছিলেন স্যামুয়েল ওগডেন এডিসনের সপ্তম সন্তান । তার মায়ের নাম ছিল ন্যান্সি ম্যাথিউজ এলিয়ট ।
আরো পড়ুন আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনী
টমাস আলভা এডিসনের প্রাথমিক জীবন
টমাস আলভা এডিসন টমাস আলভা এডিসনকে অনেকে বলেন , ‘ আবিষ্কারের মেশিন ‘ । সহস্রাধিক ছোট বড় আবিষ্কারের জনক তিনি ৷ তাঁর বয়স যখন মাত্র সাত বছর তখনই তিনি একটি পরীক্ষাগার তৈরি করে ফেলেছিলেন টুকিটাকি জিনিস দিয়ে । বিভিন্ন গাছের পাতা পানিতে মিশিয়ে সেই দ্রবণগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন রং বদলায় কিনা । দরিদ্র পরিবারের সন্তান টমাস আলভা এডিসন কিশোর বয়স থেকেই ঘোড়ার গাড়ি চালাতেন আর বাজারে সবজি বিক্রি করতেন । তা থেকে যা আয় হতো তার বেশিরভাগই খরচ হতো রাসায়নিক দ্রব্য কেনার জন্য । সতেরো বছর বয়সে এডিসন একটা চাকরি নিলেন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে । তখন টেলিগ্রাফ অফিস থেকে একই সময়ে একটির বেশি সঙ্কেত পাঠানো সম্ভব হতো না । এডিসনের মনে হলো বিদ্যুতের সাহায্যে একই সঙ্গে অনেকগুলো সঙ্কেত পাঠানো সম্ভব হতে পারে । মাত্র ৩০ বছর আগে মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন । ফ্যারাডের লেখা বইটি এডিসন তখন পড়া শেষ । তাই কাউকে কিছু না বলে এডিসন নিজের বাড়িতে টেলিগ্রাফের সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন । ব্যাটারী তখন কিনতে পাওয়া যেত না, তাই এডিসন নিজেই একটা ব্যাটারী তৈরি করে নিলেন । মুলত খুব অল্প বয়স থেকেই এডিসন আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন ছিলেন ।
টমাস আলভা এডিসন এর টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার
চেষ্টার কয়েক মাসের মধ্যেই টমাস আলভা এডিসন একটা টেলিগ্রাফ যন্ত্র তৈরি করে ফেললেন । যার সাহায্যে এক সঙ্গে অনেক গুলো সঙ্কেত পাঠানো যেতো । কিন্তু টমাস আলভা এডিসন তার আবিষ্কারটি আগেই প্রকাশ না করে, সেটা বিক্রি করতে চাইলেন । তখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় টেলিগ্রাফ কোম্পানি ছিলো ‘ গোল্ড ইনডিকেটর টেলিগ্রাফ ’ । তিনি সেখানে গিয়ে প্রস্তাবটি রাখতেই পেলেন অপ্রত্যাশিত প্রতিদান । কোম্পানি এডিসনকে দিলো নগদ চল্লিশ হাজার ডলার । ১৮৭০ সালে এই টাকার মূল্য যে কতো ছিল সেটা বুঝিয়ে বলা যাবে না । এই অর্থ নিয়ে টমাস আলভা এডিসন নিউইয়র্ক থেকে ৪০ মাইল দূরে মেনলো পার্ক নামক জায়গায় বিশাল এক কারখানা খুলে ফেললেন । সেই কারখানার শ্রমিক ছিল একশ’রও বেশি । সেখানে তৈরি করা হতো টেলিগ্রাম যন্ত্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ৷
আরো পড়ুন আলফ্রেড নোবেল এর জীবনী
টমাস আলভা এডিসন এর ফনোগ্রাফ আবিষ্কার
এভাবে টমাস আলভা এডিসন বিরাট শিল্পপতি হয়ে উঠতে পারতেন । কিন্তু তাঁর আবিষ্কারের নেশা ছিল । একদিন টমাস আলভা এডিসন একটা জনসমাবেশ ডাকলেন। স্টেজের ওপর একটা হাতাওয়ালা টিনের সিলিন্ডার নিয়ে তিনি দ্ড়ালেন । সিলিন্ডারের ওপর একটা সরু পিন এবং তার পিনের সঙ্গে আটকানো ছিল একটা ধাতব চোঙ । তিনি হাতলটাকে ঘোরাতে শুরু করলেন আর গান ধরলেন , ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’। গানটি শেষ করে দুটি তার নতুন করে যোগ করলেন একটা ব্যাটারীর সঙ্গে । তারপর আবার ঘোরাতে শুরু করলেন সেই হাতলটা । চোঙের ভিতর থেকে ভেসে এলো সেই একই কন্ঠ , একই সুর । দর্শকরা মনে করলো এটা ম্যাজিক । কিন্তু টমাস আলভা এডিসন তাঁদের বললেন , এটা ম্যাজিক নয় , এটা বিজ্ঞান । যন্ত্রটা আধুনিক গ্রামোফোনের আদিরূপ , এডিসন নাম দিয়েছিলেন ফোনোগ্রাফ । ফোনোগ্রাফ যখন আবিষ্কার করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ বছর। এত অল্প বয়সে একসঙ্গে বিত্তশালী ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা আর কারু পক্ষেই সম্ভব হয়নি ।
টমাস আলভা এডিসন এর বিদ্যুৎ আবিষ্কার
১৮৭৮ সালে এডিসনের খেয়াল চাপল মানুষকে বৈদ্যুতিক আলো দেখাবেন । রাস্তায় তখন টিমটিম করে জ্বলতো গ্যাসের আলো । বাড়ির ভিতর মোম বা তেলের বাতির আলো । টমাস আলভা এডিসন চিন্তা করলেন এমন কোনো জিনিস খুঁজে বের করা দরকার যার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ গেলে গরম ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । হাতের কাছে যা পান তা দিয়েই তিনি ব্যাটারীর দু’প্রান্ত যোগ করে পরিক্ষা চালাতে লাগলেন । প্রথমে তামার তারে কাগজ জড়িয়ে পরিক্ষা করে দেখলেন কাগজটা গরম হয়ে উঠছে আর একটু পরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে । তারপর নরম ধাতু নিয়ে পরীক্ষা করলেন । ধাতুগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, কিন্তু একটু পরেই গলে গেল । তার মনে হলো , দহনে সাহায্য করছে হয়তো বাতাসের অক্সিজেন । তাই এবার একটা কাঁচের পাত্রের বাতাস যথাসম্ভব বের করে নিলেন । এবার তার ধারণাই ঠিক হলো । ধাতব ফিলামেন্টটি জ্বলল দশ মিনিট ধরে । একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো, প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে উঠলেন টমাস আলভা এডিসন ।
আরো পড়ুন লিভার সিরোসিস কি । লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা ।
এরপর নানারকম জিনিসের ফিলামেন্ট তৈরি করে পরীক্ষা করতে লাগলেন এডিসন । এডিসনের জীবনী লেখক ’নরম্যান ওয়াইমার’ বলেছিলেন, এডিসন প্রায় ন’হাজার রকম জিনিসের ফিলামেন্ট তৈরি করেছিলেন । কিন্তু এগুলোর কোনটিই ঠিকমতো কাজ করেনি । অন্য কেউ হলে হয়তো এ গবেষণা থেকে বিরত থাকতেন ।
একদিন রাতে টেবিলে বসে চিন্তা করছিলেন এডিসন । এমন সময় পাশে রাখা ল্যাম্পের তেল ফুরিয়ে আসছিলো । তাই সলতেটা বাড়িয়ে দিতেই ভুষো কালি বেরোতে লাগলো । এডিসনের হঠাৎ মনে হলো, কার্বন তো কোন জিনিসের তেতে ওঠার ব্যাপারে বাধা দিতে পারে । তখন ছুটে গিয়ে নিয়ে এলেন একটি কাপড় সেলাই করার সুতা । সেটিকে পানিতে ভিজিয়ে, কার্বনে মাঞ্জা দিয়ে উনুনে দিয়ে শুকিয়ে নিলেন । তারপর কাঁচের জারের ভিতর রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় ব্যাটারীর সঙ্গে যোগ করে দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল আলো ।
বাতিটি জ্বলছে কিনা বোঝাই যাচ্ছিলো না । কিন্তু আলোটি জ্বলছে তো জ্বলছেই , আর নেভেই না । আলোটা নিভল ৪৫ ঘণ্টা জ্বলার পর অর্থাৎ দুদিন পর । এই পুরোটা সময় এডিসন আলোটার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন । দু্ই রাত তিনি ঘুমাননি । খাবার দিয়ে যাওয়া হতো আলোটির পাশে । কিন্তু আলোটি নিভে যাওয়ার পর এডিসন খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না । তিনি চাইছিলেন আরও বেশিক্ষণ জ্বলুক বৈদ্যুতিক আলো । তাই আবার শুরু হলো গবেষণা ।অবশেষে দেখলেন কার্বন ভেজানো বাঁশের আঁশ দিয়ে ফিলামেন্ট তৈরি করলে আলোটি কয়েক মাস ধরে জ্বলবে । তাও আবার যে সে বাঁশ নয় । দক্ষিণ আফ্রিকার আমাজান নদীর তিরে যে বাঁশ জন্মে তার কার্যকারিতাই সবচেয়ে বেশি ।
এরপর ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি মেলো পার্কের গাছে গাছে আর ল্যাম্পপোষ্টে ঝোলানো হলো টমাস আলভা এডিসনের তৈরি শতাধিক বাল্ব । দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠল রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি । টমাস আলভা এডিসন উপস্থিত সবাইকে বলতে লাগলেন ‘এ আর কি দেখছেন, সারা শহর আমি আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারি ।টমাস আলভা এডিসন প্রমাণ করে দিলেন আড়াই বছর পরেই, ১৮৮২ সালের ৪ ঠা সেপ্টেম্বর রাতে । এর আগে সরকারের অনুরোধে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে নিউইয়র্ক শহরের মাটির নিচে বৈদ্যুতিক লাইন পাতার কাজ করালেন । প্রায় এক হাজার বাড়িতে ইলেক্ট্রিক ওয়ারিং করা হলো । তাছাড়া একটি বড় শহরে তো আর ব্যাটারী দিয়ে আলো জ্বালানো যায় না । তাই একটা পাওয়ার হাউজও তৈরি করেছিলেন ।
টমাস আলভা এডিসন এর মৃত্যু
বিশ্ব ইতিহাসের বিস্ময়কর প্রতিভা মহান বিজ্ঞানী এডিসন ১৯৩১ সালের ১৮ ই অক্টোবর ওয়েস্ট অরেঞ্জে ৮৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন ।