জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙ্গালী কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক । রূপময় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বাংলা কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্ৰত্তর যুগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি । জীবনানন্দ দাশের জন্ম, শিক্ষা, কর্মজীবন, সাহিত্যকর্ম এবং অর্জন নিয়ে আলোচনা থাকছে আজকের আয়োজনে ।
জীবনানন্দ দাশের সংক্ষিপ্ত জীবনী
একনজরে
জন্ম | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ |
জাতীয়তা | বাঙালি |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় (১৮৯৯-১৯৪৭) ভারতীয় (১৯৪৭-১৯৫৪)
|
শিক্ষা | স্নাতোকোত্তর (ইংরেজি সাহিত্য) মাতৃশিক্ষায়তন প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, গীতিকার, সম্পাদ, কঅধ্যাপক
|
উল্লেখযোগ্য কর্ম
| সাতটি তারার তিমির, বনলতা সেন, রূপসী বাংলা
|
দাম্পত্য সঙ্গী | লাবণ্য গুপ্ত |
পুরস্কার | রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫২) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৫)
|
মৃত্যু | ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ (বয়স ৫৫) কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
|
জন্ম
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন । জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার বড় সন্তান । তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু । জীবনানন্দ দাশের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী কিন্তু কবি হিসাবে তার সুপরিচিতি ছিল । তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা ”আদর্শ ছেলে” (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় ।
শিক্ষাজীবন
জীবনানন্দ দাশের পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন । এই কারণে বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত হয় । ১৯০৮ সালের জানুয়ারীতে আট বছর বয়ষে জীবনানন্দকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয় । ১৯১৫ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দু’বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্বের ন্যায় প্রথম বিভাগ লাভ করেন । ১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ২য় শ্রেণিতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন । এরপর তিনি আইন বিষয়ে ভর্তি হন কিন্তু পরিক্ষায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন ।
কর্মজীবন
কর্মজীবনে জীবনানন্দ দাশ কোথাও স্থায়ী হতে পারেন নাই । দারিদ্র্যতা ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী । ১৯২২ সালে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন । ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কলেজটিতে ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেয়, ফলে কলেজটির ছাত্রভর্তির হার কমে যায়। এ কারণে অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাকেও ছাঁটাই করে কলেজ কর্তৃপক্ষ । পরবর্তীতে বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন । কিন্তু মাত্র দুই মাস কুড়ি দিন পরেই তিনি চাকুরী ছেড়ে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন । ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তাঁর চাকরির মেয়াদ ছিল মাত্র চার মাস । ১৯৩০ সালের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন । বিয়ের পর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন । কিছু দিন একটি বীমা কোম্পানির অ্যাজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন । ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসা করেছেন কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী হয়নি । ১৯৩৫ সালে জীবনানন্দ তাঁর পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে আসেন । যা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল । তিনি সেখানে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন । ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে সপরিবারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । কলকাতায় তিনি ”দৈনিক স্বরাজ” পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন । কিন্তু এই চাকুরির স্থায়ীত্ব ছিল ছিল মাত্র সাত মাস । ইতোমধ্যেই জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন । তিনি ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন । সু-স্থির জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে । একটি চাকুরির জন্য তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন । ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন ।
আরো পড়ুন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী
সাহিত্যকর্ম
মা কুসুমকুমারী দাশের উৎসাহে ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি । ১৯১৯ সালে তার লেখা ”বর্ষা আবাহন “ কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা । জীবদ্দশায় তার ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় । ১৯২২ সালে সিটি কলেজের অধ্যাপনা চলাকালীন সময়ে ”ঝড়া পালক” কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হয়- ধূসর পান্ডুলিপি , সাতটি তারার তিমির , রূপসী বাংলা , মহাপৃথিবী , বেলা অবেলা কাল বেলা , বনলতা সেন । তার রচিত বনলতা সেন আধুনিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ।
জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি । অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন । তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি । ২০১৫ সাল অবধি তার প্রকশিত রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২১ এবং ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক । তিনি সম্পূর্ণ নিভৃতে উপন্যাস-ছোটগল্প লিখেছিলেন এবং জীবদ্দশায় একটিও প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেননি । জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর উপন্যাস-গল্পের পাণ্ডুলিপির খাতাগুলো আবিষ্কৃত হয় ।
পুরস্কার
১৯৫২ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে ”বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয় । কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য এ্কাডেমি পুরস্কার লাভ করে ।
মৃত্যু
১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ আহত হন । ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর থেতলে গিয়েছিল । ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড় । গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দ দাশকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে । চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কবির মৃত্যু হয় ।
আরো পড়ুন পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের সংক্ষিপ্ত জীবনী